মুসলিম সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি ব্যবহৃত হয় মসজিদটির
কারুকাজে

হাজারো তারার ঝিকিমিকিতে সদ্য অজু করে মসজিদে প্রবেশ করা মুসল্লিদের মন এক অপার্থিব ভালো লাগায় ভরে ওঠে। এ মসজিদজুড়ে শুধু তারার মেলা, ডানে-বামে, উপরে-নিচে সবখানে শুধু তারা আর তারা। শুধু তা-ই নয়, এ মসজিদের সীমানা প্রাচীরের ওপর লোহার যে গ্রিল লাগানো রয়েছে, সেখানেও তারার ডিজাইন করা হয়েছে। অন্যদিকে মসজিদের সামনে সুবিশাল খোলা জায়গায় এক বিরাট আকৃতির তারার প্রতিকৃতি রয়েছে, তার মাঝে রয়েছে একটি সুদৃশ্য মনোরম ঝরনা। আর সেখানে মুসল্লিদের বসার জন্য সাদা টাইলসের মেঝের ফাঁকে মোট পাঁচ জায়গায় নরম ঘাসের গালিচা আছে, যেখানে মুসল্লিরা নামাজ আদায় শেষে বিকালে বা সন্ধ্যায় খোশগল্পে মেতে ওঠেন। মসজিদের পাশ দিয়ে যে পথিকই হেঁটে যান অথবা যানবাহনের আরোহী যারা থাকেন, তারা এ মসজিদটির দিকে একবার হলেও ভালো লাগার চোখে তাকাতে বাধ্য হন। কেননা এ মসজিদটির অনন্য সৌন্দর্য এককথায় অতুলনীয়। তাই তো প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে তারা মসজিদের চত্বর। তারা এখানে এসে ছবি তোলেন আর বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকেন ইসলামী সভ্যতার এ অনন্য নিদর্শনটির প্রতি।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৮ শতকে ঢাকার ‘মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ’-এ (আবু সাঈয়ীদ বংশের মহল্লা, যা পরে নাম হয় আরমানিটোলা) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি ব্যবহৃত হয় মসজিদটির কারুকাজে।
এ মসজিদে মোগল স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব রয়েছে। ঢাকার কসাইটুলীর মসজিদেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
উল্লেখ্য, দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরের ১৭ শতকে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের ছাপ পড়ে মোগল স্থাপত্যশৈলীতে। (স্থাপত্য : বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-২, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি)।
মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজওয়ালা, দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) আর প্রস্থ ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)। আলী জানের সংস্কারের সময় ১৯২৬ সালে মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুইটি গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। পরে মসজিদের জুল্লায় প্রবেশের জন্য পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পথ সৃষ্টি করা হয়। (ঢাকা : স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন)।
এ খিলানগুলো বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং চারটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ থেকে উত্থিত। মসজিদের অভ্যন্তরে ও বাইরে সম্পূর্ণরূপে মোজাইক নকশা করা। এ গাত্রালংকারে চীনামাটির প্লেট, পেয়ালা ইত্যাদির ছোট ভগ্নাংশ ও কাচের টুকরা ব্যবহৃত হয়েছে। এ পদ্ধতিকে ‘চিনি-টিকরি’ বা চিনি দানার কাজ বলা হয়। ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, এক বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র ও আরবি ক্যালিগ্রাফিক লিপি মসজিদের গাত্রনকশায় বিধৃত হয়েছে। এ মসজিদের অলংকরণ জুল্লার অভ্যন্তরে ফুলদানি থেকে উত্থিত ফুলগাছ, খিলান শীর্ষে পেন্ডেন্টিভের ওপর ও দেয়ালগাত্রে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। বারান্দায় গাত্রালংকারে জাপানের বিখ্যাত ‘ফুজিসান’ এর দৃশ্য-সংবলিত গ্লেস টাইল উল্লেখযোগ্য। ‘ফাসাদ’ এর কেন্দ্রে আরবি লিপি-সংবলিত সূক্ষè অর্ধচন্দ্র ও তারার অলংকরণ স্থান পেয়েছে। বৃত্তাকার শ্বেত-শুভ্র গম্বুজগুলোতে বসানো হয়েছে নীল রঙের অসংখ্য তারা বা নক্ষত্র। সমগ্র নকশায় সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে তারার ‘মোটিফ’; তাই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে খ্যাত।
মসজিদের বতর্মান দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)। ২০১৫ সালে একবার নৌ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ফলে আরও ২১টি স্থাপনার সঙ্গে ‘তারা মসজিদ’ও ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পরে আর সেটা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এ মসজিদে প্রতি ওয়াক্তেই প্রায় শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। জুমার নামাজে ও রমজানের সময় এ মসজিদের সামনে টাইলস বিছানো খোলা জায়গায় মুসল্লিদের নামাজের সুবিধার্থে সুবিশাল শামিয়ানা টানানো হয়।
বর্তমানে মসজিদটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। মসজিদটির পাশেই রয়েছে মাদরাসা, যার দেখাশোনাও মসজিদ কর্তৃপক্ষই করে থাকে। বর্তমানে মাদরাসাটির মক্তবে দুই বেলা ২৫০ জন ছাত্র, হেফজখানায় ৪০ জন ছাত্র পড়াশোনা করছে আর শিক্ষক হিসেবে মক্তবে পাঁচজন ও হেফজখানায় দুইজন দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে মসজিদটি স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে গঠিত কমিটিই এর পরিচালনা করছে। পদাধিকার বলে এ কমিটির সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। মসজিদের উন্নয়ন ও বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রতি বছর বাংলাদেশ সরকার ৩ লাখ টাকা প্রদান করে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষে আর সময়ের প্রয়োজনে এ মসজিদটিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, তবে এ মসজিদে খোলা আকাশের নিচে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলেও এক অসাধারণ তৃপ্তি পাওয়া যায়। তাই এলাকার লোকজনসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিরা এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন। মসজিদটি এভাবেই কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে, শুধু মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবেই নয়, বরং ইসলামী সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন হিসেবেও তারা মসজিদ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর